২৮ এপ্রিল শেখ জামালের জন্মদিন। ১৯৫৪ সালের এই দিন গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় শেখ মুজিব- ফজিলাতুন্নেছা দম্পতির ঘরে তার জন্ম হয়। তাকে নিয়ে লিখতে বসে চোখ ঝাপসা হয়ে উঠছে। আহা, একই বছর আমাদের জন্ম। আমি আছি, তিনি নেই। সবচেয়ে বেদনার কথা এটাই যে, তিনি স্বাভাবিক মৃত্যুবরণ করেননি। তিনি নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন। কী এক ভয়ংকর রাত এসেছিল আমাদের দেশে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট। একটি জাতিকে পিছিয়ে দেয়ার কী এক গভীর ষড়যন্ত্র হয়েছিল! ১৯৫৪ থেকে ১৯৭৫। মাত্র একুশ বছরেই কত কী ঘটনা-দুর্ঘটনা!
১৯৫৪ সাল বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাসে একটি স্মরণীয় বছর। ওই বছর ফেব্রুয়ারি মাসে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে মুসলিম লীগের পরাজয় হয়েছিল। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে গঠিত যুক্তফ্রন্ট ব্যাপক জয় পায়। শেখ মুজিব তখন আওয়ামী লীগের উদীয়মান তরুণ নেতা।
হক-ভাসানী-সোহরাওয়ার্দীর পাশাপাশি শেখ মুজিবও জনপ্রিয় হয়ে উঠছিলেন। জেলজুলুম তার নিত্য সঙ্গী। তিনি নেতা হিসেবে যত জনপ্রিয় হয়ে উঠছেন, পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর ততই চক্ষুশূল হচ্ছেন। তার সংসার-জীবন ছিল রাজনীতির ঝড়ো বাতাসে টালমাটাল। তিনি রাজনীতির বৃহত্তর অঙ্গনে জড়িয়ে পড়ছেন, আর সংসারের ভার সামলানোর কঠিন কাজটি স্বেচ্ছায় কাঁধে তুলে নিতে হচ্ছে বেগম মুজিবকে। যুক্তফ্রন্টের বিজয়ে যখন বাঙালি আনন্দিত, সে সময়ই শেখ জামালের জন্ম। তবে ওই জয়ের আনন্দ বাঙালির জীবনে স্থায়ী হয়নি। শেখ জামালের জীবনের শুরুটাও তাই পিতার আদর-ভালোবাসায় পূর্ণ হয়ে উঠতে পারেনি।
শেখ জামালের আগে তার আরও এক বোন এবং এক ভাই পৃথিবীর আলো দেখেছেন। শেখ হাসিনা এবং শেখ কামাল। তৃতীয় সন্তান শেখ জামালকে নিয়ে শেখ মুজিব আর কী আশা বা স্বপ্ন দেখবেন, তিনি তাকে সঁপে দিয়েছেন দেশের সেবায়, দেশের মানুষের বৃহত্তর কল্যাণে। ফলে মায়ের স্নেহ-ভালোবাসায় বেড়ে উঠতে থাকে সন্তানরা।
মুজিব সামলান রাজনীতি আর সংসার-সন্তান সামলান বেগম মুজিব। এই পরিবারের ছেলেমেয়েরা তাই এক বিশেষ পরিবেশে বড় হয়েছেন। তারা শিশুকাল থেকেই দেখেছেন নানা সমস্যা মোকাবিলা করে তাদের মা তাদের চলার পথ তৈরি করে দিতে কত দুঃখকষ্ট হাসিমুখে সহ্য করেন। বাবা বেশি সময় থাকেন জেলে। জেলের বাইরে থাকলেও সংসার-সন্তানদের সময় না দিয়ে মেতে থাকেন দল এবং দলের নেতা-কর্মীদের নিয়ে। সংগঠনের কাজে ছুটে বেড়ান শহর থেকে গ্রামে।
বড় ভাই কামাল যেমন চটপটে মিশুকে স্বভাবের ছিলেন, জামাল তেমন ছিলেন না। জামাল একটু চাপাস্বভাবের। কথা কম বলতেন, তবে এটা বুঝতেন যে কঠিন পরিস্থিতি মোকাবিলা করেই তাকে বড় হতে হবে।
শেখ মুজিব রাজনীতির আকাশে উজ্জ্বল নক্ষত্র হয়ে উঠলেন। হলেন বঙ্গবন্ধু। কিন্তু শেখ জামাল নিজের মতো করে নিজেকে তৈরি করতে থাকলেন। ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে স্বাধীনতা ঘোষণা দিয়ে বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানিদের হাতে বন্দি হলেন। কিন্তু শুরু হয়ে যায় মুক্তিযুদ্ধ। পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে শেখ জামালও বন্দিজীবন কাটাতে থাকেন ধানমন্ডির একটি বাড়িতে।
ঢাকা রেসিডেনসিয়াল মডেল স্কুল থেকে এসএসসি পাস করে ঢাকা কলেজে ভর্তি হওয়া ওই তরুণ একদিন জীবনের ঝু্ঁকি নিয়ে বাড়ি থেকে পালিয়ে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিতে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ভারতে চলে যান। তিনি উত্তর প্রদেশের কালশীতে বাংলাদেশ লিবারেশন ফোর্সের একজন সদস্য হিসেবে সামরিক প্রশিক্ষণ নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। বাংলাদেশ শত্রুমুক্ত হওয়ার পর বিজয়ীর বেশে দেশে ফেরেন তিনি।
সামরিক জীবন পছন্দ করেছিলেন শেখ জামাল। তিনি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। সেনাবাহিনীর লং কোর্সের প্রথম ব্যাচের কমিশন্ড অফিসার তিনি। ১৯৭৪ সালের জানুয়ারি মাসে যুগোস্লাভিয়ার প্রেসিডেন্ট মার্শাল টিটো বাংলাদেশ সফরে এসে শেখ জামালের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে তাকে যুগোস্লাভিয়ার মিলিটারি একাডেমিতে ভর্তির জন্য আহ্বান জানালে শেখ জামাল রাজি হন। বঙ্গবন্ধুও পুত্রের ইচ্ছার বিরুদ্ধে অবস্থান না নিয়ে তাকে যুগোস্লাভিয়ায় যাওয়ার সুযোগ করে দেন।
পরিবেশগত কারণে শেখ জামাল যুগোস্লাভিয়ার মিলিটারি একাডেমিতে খাপ খাওয়াতে না পারায় মার্শাল টিটো তাকে ব্রিটেনের স্যান্ডহার্স্টে প্রশিক্ষণ গ্রহণের ব্যবস্থা করে দেন। সেখানে তিনি সফলভাবে প্রশিক্ষণ শেষে দেশে ফিরে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে যোগদান করেন।
মাত্র দেড় মাসেই একজন চৌকস সেনা কর্মকর্তা হিসেবে শেখ জামাল বাহিনীর সবার মন জয় করতে সক্ষম হয়েছিলেন। তিনি তার বাবার পরিচয়ে নয়, নিজের নিষ্ঠা এবং দক্ষতা দিয়েই সামনে এগিয়ে যেতে চেয়েছিলেন।
১৯৭৫ সালের ১৭ জুলাই শেখ জামাল বিয়ে করেছিলেন পারভীন রোজীকে। স্বপ্ন দেখেছিলেন এক নতুন জীবনের। কিন্তু ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস, বিয়ের এক মাস পূর্ণ না হতেই ১৫ আগস্ট রাতে ধানমন্ডির বাড়িতে বাবা-মা-ভাইসহ শেখ জামাল ও রোজীকেও জীবন দিতে হয়।
যে বাহিনীর একজন গর্বিত সদস্য হিসেবে তিনি নিজেকে প্রস্তুত করছিলেন, সেই বাহিনীর কিছু বিপথগামী সদস্য তাকে সপরিবারে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করে কলঙ্কিত করল দেশকে, দেশের ইতিহাসকে।
শেখ জামাল বেঁচে থাকলে কোন উচ্চতায় পৌঁছতে পারতেন, সে আলোচনা এখন অর্থহীন। তবে এটা ঠিক, তার মধ্যে দীপ্তি ছিল, সম্ভাবনা ছিল। রুচি ও সংস্কৃতিবোধের সংমিশ্রণ ছিল। গিটার বাজানো শিখতেন। সুর দিয়ে অসুর দমনের ইচ্ছা হয়তো ছিল। কিন্তু অস্ত্র হাতে একদল অমানুষ রাতের অন্ধকারে হিংসায় মত্ত হয়ে অমিতসম্ভাবনাময় কয়েকটি সুন্দর জীবন, একটি সাজানো বাগান যেন তছনছ করে দিল।
শেখ জামাল এবং তার সব ভাই-বোন দেশকে ভালোবাসার শিক্ষা পেয়েছিলেন পরিবার থেকেই। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব এবং মা বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব সন্তানদের আত্মকেন্দ্রিক নয়, দেশপ্রেমিক হওয়ার যে শিক্ষা দিয়েছিলেন; দৃঢ়তার সঙ্গে যেকোনো পরিস্থিতি মোকাবিলার যে সাহস তাদের মনে সঞ্চার করেছিলেন, তা এখন রূপকথার গল্প হয়ে বাঙালির কাছে স্মরণীয় হয়ে আছে। পালিয়ে বাঁচা নয়, মরেও যে মানুষের মনে বেঁচে থাকা যায় শেখ জামাল তার উজ্জ্বল প্রমাণ।
জন্মদিন উপলক্ষে তার প্রতি শ্রদ্ধা।
লেখক: সাংবাদিক, কলাম লেখক, রাজনৈতিক বিশ্লেষক।